👉👉👉স্বামী বিবেকানন্দ (১৮৬৩-১৯০২)
ভারতীয়দের মধ্যে যে সকল মহাপুরুষ, ভারত বর্ষকে, ভারতীয় সনাতন হিন্দু ধর্ম কে বিশ্বের দরবারে তুলে ধরেছিলেন ও বিশ্বকে ভারতীয় ধর্ম ও সংস্কৃতির সাথে পরিচয় করিয়েছিলেন তিনি হলেন স্বামী বিবেকানন্দ | তিনি ভারতীয়
যুবসমাজকে গভীর দেশপ্রেমের মন্ত্রে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন |তার হাত ধরেই ভারতীয় যুব সমাজে জাতীয়তাবাদের উন্মেষ ঘটেছিলো |তিনি ছিলেন হিংধুধর্মর পুনজাগরণের অন্যতম কান্ডারি |
জন্ম ও বংশপরিচয় >
স্বামী বিবেকানন্দ কলকাতায় তৎকালীন সিমলা নামক অঞ্চলের উচ্চবিত্ত দত্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন |১২ জানুয়ারী,১৮৬৩ সালে | ছোটবেলায় তার নাম ছিল নরেন্দ্রনাথ দত্ত, এবং তার ডাকনাম ছিল "বিলেশ্বর "বা বিলে,
মায়ের খুবই আদরের ছিলেন তিনি |
তার পিতা বিশ্বনাথ দত্ত ছিলেন তৎকালীন সময়ের একজন নামকরা উকিল| এবং মাতা ছিলেন শ্রীমতি ভুবনেশ্বরী দেবী, | নরেন্দ্রনাথ তার বাবার কাছে শৃঙ্খলা ও অনুশাসন, এবং মায়ের কাছ থেকে শিখেছিলেন ভক্তি, অধ্যাত্মিকতা ও মানুষকে ভালোবাসার মহান শিক্ষা | ছোটো বেলা থেকেই তিনি খুবই দুরন্ত ও বুদ্ধিমান ছিলেন |তার একটি প্রিয় খেলা ছিল " ধ্যান ধ্যান খেলা " তিনি প্রচুর ধ্যান করতেন | এইজন্য তার অসাধারণ ধীশক্তি ছিলো |একবার ছোটো বেলায় বন্ধুদের সাথে ধ্যান ধ্যান খেলার সময় তিনি ধ্যানের মধ্যে এতটাই নিমগ্ন হয়ে গিয়েছিলেন যে একটি বিষধর সাপ কখন তার
গায়ের উপর হয়ে চলে গিয়েছিলো তিনি বুঝতেই পারেননি | এই কান্ড দেখে তার বন্ধুরা ভয় পেয়ে গিয়েছিলো |তিনি অত্যন্ত সাহসী ছিলেন |
শিক্ষাজীবন >
তিনি ১৮৭১ খ্রিস্টাব্দে বিদ্যাসাগরের "মেট্রোপোলিটন ইনস্টিটিউশন " তে ভর্তি হন |এর দুবছর পরে তিনি "প্রেসিডেন্সি কলেজের " প্রবেশিকা পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে উর্তীর্ণ হন |দর্শন, ধর্ম, ইতিহাস, সমাজবিজ্ঞান, শিল্পকলা ও সাহিত্য বিষয়ে বই পড়ায় তার বিশেষ আগ্রহ ছিল| বেদ, উপনিষদ ভাগবদগীতা, রামায়ণ , মহাভারত , পুরান প্রভৃতি হিন্দু ধর্মগ্রন্থ পাঠেও তার আগ্রহ ছিল। এছাড়া তিনি হিন্দুস্থানি শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে তালিম নিতেন এবং নিয়মিত অনুশীলন, খেলাধুলো ও সমাজসেবামূলক কাজকর্মে অংশ নিতেন।
জেনেরাল এসেম্বলির (অধুনা স্কতীশ চার্চ কলেজ, কলকাতা) পড়ার সময় নরেন্দ্রনাথ পাশ্চাত্য যুক্তিবিদ্যা , পাশ্চাত্য দর্শন ইউরোপীয় ইতিহাস অধ্যয়ন করেছিলেন। ১৮৮১ খ্রিষ্টাব্দে তিনি চারুকলা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। ১৮৮৪ খ্রিষ্টাব্দে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। নরেন্দ্রনাথ , . এফ. হেগেল, আর্থার সোফেনহায়ার, , জন স্টুয়ার্ট মিল, চার্লস ডারউইন এর বিবর্তনবাদের প্রতি তিনি বিশেষভাবে আকৃষ্ট হয়েছিলেন। সে সময়ে স্পেনসারের সঙ্গে তার চিঠিপত্র বিনিময়ও চলত। স্পেনসারের এডুকেশন (১৮৬১) বইটি তিনি বাংলায় অনুবাদ করেছিলেন। পাশ্চাত্য দার্শনিকদের রচনাবলি পড়ার সঙ্গে সঙ্গে তিনি
ভারতীয় সংস্কৃত ভাষায় ও শিক্ষা গ্রহণ করেন |
তিনি তার পড়াশোনার সময় থেকেই পরমহংস রামকৃষ্ণ দেবের নাম শুনেছিলেন |১৮৮১ খ্রিস্টাব্দে তিনি একদিন রামকৃষ্ণ দেবের সাথে দেখা করেন, তাছাড়াও তিনি একদিন সুরেন্দ্রনাথ মিত্রের বাড়িতে শাস্ত্রীয় সংগীত গাইতে একটি আসরে যান, যেখানে ধর্মীয় কথা বলার জন্য রামকৃষ্ণ দেবও এসেছিলেন |সেখানে তাঁদের মধ্যে বাক্যালাপ হয় |রামকৃষ্ণ দেবের সাথে সাক্ষাৎ তার জীবনে এক অভাবনীয় পরিবর্তন নিয়ে আসে| তিনি রামকৃষ্ণ দেবকে গুরু হিসেবে বরণ করেন এবং তার কাছে দীক্ষা নেন এবং "স্বামী বিবেকানন্দ " নাম গ্রহন করেন |এর কিছুদিন পর হঠাৎই তার পিতার মৃত্যু হয় এবং তাঁদের সংসারে চরম আধার নেমে আসে | এইসময় তিনি রামকৃষ্ণের কাছে গেলে তিনি তাকে কালিমায়ের কাছে প্রার্থনা করে কিছু চাইতে বলেন, যাতে করে তার অভাব অনটন দূর হয়ে যায় |কিন্তু তিনি মায়ের কাছে গিয়ে নিজের জন্যই কিছুই চাইতে পারলেন না বদলে তিনি " মা আমায় বৈরাগ্য দাও, জ্ঞান দাও, ধৈর্য দাও " এইগুলোই চাইতে পারলেন |শেষে নিজের জন্যই কিছু চাইতে না পারায় রামকৃষ্ণ দেব তাকে আশীর্বাদ করে বললেন --" নে তোর সংসারে কখনো মোটা কাপড় আর ভাতের অভাব হবে না |", এমনই বৈরাগী ছিলেন এই মহান সন্ন্যাসী |এরই কিছুদিনের পরে শ্রীরামকৃষ্ণ দেবের গলায় ক্যান্সার ধরা পরে এবং ১৮৮৭ খ্রিস্টাব্দে ১৬ আগস্ট রামকৃষ্ণ দেব মারা যান| তার শিষ্যরা তার সেবা করতো তারা তীব্র সংকটের মধ্যে পরে যায় |এই সময় বরাহনগরে ভাড়া বাড়িতে মানব জাতির কল্যাণের উদ্দেশে প্রতিষ্ঠা করেন "রামকৃষ্ণ মিশন " এখানে তিনি এবং তার সাহচরেরা গভীর ধ্যান এবং ব্রহ্মচর্য পালন করতেন এবং ধর্ম চর্চা ও দর্শন নিয়ে আলোচনা করতেন |
এরপর ১৮৮৮ সাল নাগাদ সন্ন্যাসী গেরুয়া বস্ত্র হয়ে সারা ভারত পরিব্রাজক পুরে ভ্রমণ করতে থাকেন, এইসময় তিনি ভারতের খুদা দারিদ্র সম্বলিত মানুষের দুঃখ যন্ত্রনা, পরাধীনতার অন্ধকার দিক সম্পর্কে অবগত হন | তিনি বুঝতে পারেন কিভাবে ভারতীয় সংস্কৃতি ধ্বংসের পথে চলে যাচ্ছে | তিনি পায়ে হেঁটে সাড়া দক্ষিনাত্য সহ পুরো ভারত ভ্ৰমণ করেন |এইসময় তিনি বিভিন্ন রাজ্যে, রাজসভায় অতিথি হিসেবে যাপন করেন এবং ভারতের সবচেয়ে দক্ষিণে কন্যাকুমারী পাহাড়ে তিনদিন পর্যন্ত ধ্যানে মগ্ন থেকে ভারতীয় ধর্ম ও সংস্কৃতি সম্পর্কে গভীর জ্ঞান লাভ করেন |
এরপর তিনি আমেরিকাতে হওয়া "মহা ধর্ম সম্মেলনে " যোগ দিতে আমেরিকা পাড়ি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন, পথে তিনি জাপান হয়ে জাপান দেশ ভ্ৰমণ করে আমেরিকার শিকাগোতে পৌঁছান | তিনি বহু সমস্যার সাথে মোকাবিলা করে শেষ পর্যন্ত শিকাগো ধর্ম সম্মিলনীতে বক্তৃতা রাখার সুযোগ পান |তিনি তার বক্তৃতার শুরুতে যে "আমার আমেরিকার সব ভাই ও ভগিনী গণ বলে সম্বোধন করেন " যা সভায় উপস্থিত সকল মানুষকে মুগ্ধ করে দেয় |এরপর তিনি প্রায় তিনদিন ধরে বক্তৃতা দিতে থাকেন এবং সবাই মন্ত্রমুগ্ধর মতো তার কথা শুনতে থাকেন |এইভাবে তিঁনিই সর্বপ্রথম সনাতন হিন্দুধর্ম কে বিশ্বের কাছে পরিচিত করে তোলেন |তিনি এইভাবে বিভিন্ন জায়গা থেকে আমন্ত্রণ পান বক্তৃতা দেওয়ার জন্যই |এরপর তিনি ইংল্যান্ডে পাড়ি দেন এবং ভ্ৰমণ করতে থাকেন এইসময় তিনি" মারগারেট নোবেল" নাম এক আইরিশ মহিলাকে দীক্ষা দেন এবং ভারতে ঐ মহিলা চলে আসেন ভারতীয়দের সেবা করার মহান ব্রত পালন করার জন্যই |পরে তিনি "ভগিনী নিবেদিতা " বা "Sister Nivedita " নাম অধিক পরিচিতি লাভ করেন বিবেকানন্দ ১৮৯৭ খ্রিষ্টাব্দের ১৫ জানুয়ারি কলম্বো পৌঁছান এবং এক পরমানন্দদায়ক অভ্যর্থনা গ্রহণ করেন। এখানে তিনি প্রাচ্যে তার প্রথম প্রকাশ্য বক্তৃতা (ভারত, পবিত্র ভূমি) করেন। সেখান থেকে কলকাতায় তার পৌঁছানো ছিল এক বিজয়ঘটিত প্রত্যাবর্তন। তিনি ভ্রমণ করেন কলম্বো থেকে পাম্বান, রামেস্বরম, রামনাদ, মাদুরাই, কুম্বাকোনাম এবং মাদ্রাজ। এই জায়গাগুলোতে তিনি বক্তৃতা দেন। জনগণ এবং রাজারা তাকে অত্যুৎসাহী অভ্যর্থনা জানান। পাম্বানে মিছিলে রামনাদের রাজা নিজে স্বামীজির ঘোড়ার গাড়ি টানেন। মাদ্রাজে যাওয়ার পথে কতিপয় জাগয়ায় যেখানে ট্রেন থামত না সেখানে জনগণ রেললাইনে বসে ট্রেন থামাত এবং স্বামীজির বক্তৃতা শোনার পরই ট্রেনকে যেতে দিত। মাদ্রাজ থেকে তিনি কলকাতায় তার ভ্রমণ অব্যাহত রাখেন এবং আলমোড়া পর্যন্ত তার বক্তৃতা দেওয়া চালিয়ে যান। যেখানে পাশ্চাত্যে তিনি ভারতের মহান আধ্যাত্মিক ঐতিহ্যের কথা বলেছিলেন, সেখানে ভারতে ফিরে তার 'কলম্বো থেকে আলমোড়া' বক্তৃতা ছিল জনগণের জন্য নৈতিক অনুপ্রেরণা, বর্ণাশ্রম ভাইরাস দূরীকরণ, বিজ্ঞান শিক্ষায় উৎসাহদান, দেশের শিল্পায়ন, দারিদ্র্য দূরীকরণ, ঔপনিবেশিক শাসনের অবসান। এ সমস্ত বক্তৃতা কলম্বো থেকে আলমোড়া বক্তৃতা হিসেবে প্রকাশিত হয়েছে। এই বক্তৃতাসমূহকে জাতীয়তাবাদী ঐকান্তিকতা ও আধ্যাত্মিক ভাবাদর্শের প্রকাশ বলে বিবেচনা করা হয়।
এরপর তিনি ভারতবর্ষে ফিরে রামকৃষ্ণ মিশনের উন্নতির কাজে প্রবল ভাবে মনোযোগ দেন এবং দেশের সেবার কাজে মানুষের আধ্যাত্মিক উন্নতি ঘটানোর কাজে নিজেকে নিবেদিত করেন |
স্বামীজীর আদর্শ ও বাণী >
স্বামীজীর তার কর্মধারা ও আদর্শের মধ্য দিয়ে ভারতীয় যুবসমাজ কে গভীর ভাবে প্রভাবিত করেন |তার উল্লেখ যোগ্য বানিগুলো হলো -----
- যতক্ষণ পর্যন্ত আমার দেশের একটি কুকুরও ক্ষুধার্ত, আমার সমগ্র ধর্মকে একে খাওয়াতে হবে এবং এর সেবা করতে হবে, তা না করে অন্য যা-ই করা হোক-না-কেন তার সবই অধার্মিক।
- জেগে ওঠো, সচেতন হও এবং লক্ষ্যে না-পৌঁছানো পর্যন্ত থেমো না।
- শিক্ষা হচ্ছে মানুষের মধ্যে ইতোমধ্যে থাকা উৎকর্ষের প্রকাশ।
- ধর্ম হচ্ছে মানুষের মধ্যে ইতোমধ্যে থাকা দেবত্বের প্রকাশ।
- মানুষের সেবা করা হচ্ছে ঈশ্বরের সেবা করা
স্বামীজীর সাহিত্য কর্ম >
স্বামীজী বিভিন্ন ধর্ম বিষয়ক প্রবন্ধ, পুস্তক রচনা করেছিলেন|যেমন রাজযোগ, কর্মযোগ,
সঙ্গীতকল্পতরু (১৮৮৭, সহলেখক বৈষ্ণবচরণ বসাক)
কর্মযোগ (১৮৯৬)
রাজযোগ (১৮৯৬ [১৮৯৯ সংস্করণ])
বেদান্ত ফিলোজফি: অ্যান অ্যাড্রেস বিফোর দ্য গ্র্যাজুয়েট ফিলোজফিক্যাল সোসাইটি (১৮৯৬; বাংলা অনুবাদে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে বেদান্ত)
লেকচার্স ফ্রম কলম্বো টু আলমোড়া (১৮৯৭, বাংলা অনুবাদে ভারতে বিবেকানন্দ)
বর্তমান ভারত (মার্চ, ১৮৯৯), উদ্বোধন
মাই মাস্টার (১৯০১, দ্য বেকার অ্যান্ড টাইলর কোম্পানি, নিউ ইয়র্ক; বাংলা অনুবাদে মদীয় আচার্যদেব)
বেদান্ত ফিলোসফি: লেকচার্স অন জ্ঞানযোগ (১৯০২)
মরণোত্তর প্রকাশিত
১৯০২ সালে স্বামী বিবেকানন্দের মৃত্যুর পর প্রকাশিত গ্রন্থের তালিকা
ভক্তি-প্রসঙ্গে
ভক্তিযোগ বা সর্বোচ্চ ভক্তি
প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য (১৯০৯)
দেববাণী (১৯০৯)
নারদ ভক্তিসূত্র – অনুবাদ
পরাভক্তি
প্র্যাকটিক্যাল বেদান্ত
জ্ঞানযোগ
রাজযোগ (১৯২০)
স্বামী বিবেকানন্দের বাণী সঞ্চয়ন
স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা (দশ খণ্ড)
কমপ্লিট ওয়ার্কস অব স্বামী বিবেকানন্দ (নয় খণ্ড)
স্বামীজীর মহানির্বান লাভ >
১৯০২ খ্রিস্টাদের ৪ জুলাই স্বামীজী বরাহ নগর মঠে সমাধি ধ্যানমগ্ন হয়ে তিনি তার দেহ ত্যাগ করেন |
স্বামীজীর জন্মদিন ১২জানুয়ারি কে "বিশ্ব যুব দিবস" হিসেবে পালন করা হয়ে থাকে |
Tags:
জীবনী
Sundar
উত্তরমুছুন