মহামতি চানক্য ::
চনক এর পুত্র হওয়ার সুবাদে আমরা তাকে চাণক্য নাম ডেকে থাকি |তাঁর এক একটি সিদ্ধান্ত শত্রুপক্ষকে একেবারে বিভ্রান্ত করে দিতো |তাই তিনি হলেন এক কুটিল মানুষ অর্থাৎ কৌটিল্য |
একেবারে বালক বয়স থেকেই চানক্য প্রতিভার নানা বিচ্ছুরণ আমাদের চোখে পড়ে. একবার বালক চাণক্যের পায়েল কুশের কাঁটা ফুটে ছিল |তিনি সঙ্গে সঙ্গে কুশের জঙ্গলে আগুন ধরিয়ে দিয়েছিলেন |এমনকি কুশের ছোট ছোট শেকড়কে পর্যন্ত বাঁচিয়ে রাখেন নি |বালক চাণক্যের এই প্রতিশোধস্পিহা দেখে সকলে একেবারে অবাক হয়ে গিয়ে ছিলেন |
চানক্য আজ থেকে প্রায় দুহাজার তিনশো বছর আগে পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করেছিলেন|
তিনি যখন জন্মগ্রহণ করেছিলেন তখন ভারত রাজনীতি এক ক্রান্তিকালের মধ্যে দিয়ে এগিয়ে চলেছে |চানক্য ছিলেন এক বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ | তক্ষশীলায় অর্থশাস্ত্রে অধ্যাপনা করতেন |অধ্যাপক হিসেবে চানক্য যথেষ্ট খ্যাতি এবং গৌরব অর্জন করেছিলেন |ছাত্র এবং শিষ্যদের কাছে তিনি ছিলেন সাক্ষাৎ ভগবান|
ভারতের সীমা সেই সময়ে আফগানিস্তান থেকে শুরু করে কন্যাকুমারী পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল |ভারত ছিল একটি এটা উন্নত দেশ |ভারতীয় সভত্যা ও সংস্কৃতির এই উজ্জ্বল দিকগুলির খবর বিদেশী বণিকদের কাছে পৌঁছে গিয়েছিল |তাই তারা বারবার ভারত আক্রমণ করেছেন |ভারতের সম্পদ এবং সম্পত্তি লুট করার চেষ্টা করেছেন |তখন ভারতের প্রধান শাসক ছিলেন ধননন্দ |ধননন্দের মধ্যে পৌরুষের অভাব ছিল |তিনি সহজেই লোভের বশবর্তী হতেন |বিদেশী শক্তিরা তাঁর চারিত্রিক দোষগুলি সম্পর্কে জেনে গিয়েছিলেন তাই তাকে নানা ভাবে আক্রমণ করা হয় |অথচ মগধ সাম্রাজ্যের গৌরবগাথা একসময় সারা পৃথিবীতে পরিব্যাপ্ত হয়েছিল |বর্তমান পাটনা এবং তৎকালীন পাটলিপুত্রের আশেপাশে ছড়িয়ে থাকা এক বিশাল ভূখণ্ড ছিল মগধ সাম্রাজ্যের অন্তর্গত |
মগধের সিংহাসনে আসীন ধননন্দ সূরা এবং সুন্দরীতে এত বেশি নিমজ্জিত হয়েছিলেন যে রাজকার্য পরিচালনা করার মতো সময় তাঁর কাছে ছিলোনা |তাই প্রজাদের মধ্যে থেকে প্রতিবাদের আওয়াজ ওঠে |কিন্তু একজন নেতা না থাকায় তাদের এইসব বিদ্রোহ অঙ্কুরের বিনষ্ট হয় |তাই শেষ পর্যন্ত চাণক্য এলেন জনগণের নেতা হিসেবে |তাঁর হৃদয়ে কতকগুলি ব্যাথা ছিল |তাঁর পিতা চনক ছিলেন এমন একজন নেতা |রাজদ্রোহের অপরাধে চনককে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়েছিল |
এই ঘটনাগুলি চাণক্যকে যথেষ্ট ব্যাথিত ও বিব্রত করে |একদিন রাজসভায় গিয়ে চাণক্য আর্যাবর্তের আগ্নেয় পরিস্থিতি সম্পর্কে ধননন্দকে অবহিত করেছিলেন |ধননন্দ এই কথা শুনে অত্যন্ত রেগে উঠলেন | তিনি চাণক্য কে শারীরিক এবং মানসিকভাবে আঘাত করেন |চাণক্যের মাথারশিক্ষা খুলে গিয়েছিলো |আমরা জানি একজন ব্রাহ্মনের কাছে তাঁর শিক্ষার গুরুত্ব কতখানি |চাণক্য তখনি শিক্ষা স্পর্শ করে প্রতিজ্ঞা করেছিলেন যে যতদিন পর্যন্ত ধননন্দ মগধের সিংহাসনে আসীন থাকবেন, তিনি শিখা বাঁধবেন না |
চাণক্য নিজের লক্ষপূরণের জন্য এক তরুণ উচ্চাকাঙ্খী যুবককে বেছে নিয়েছিলেন |এই যুবক টি নানাভাবে প্রতারিত এবং প্রবঞ্চিত হয়েছেন |তিনি হলেন চন্দ্রগুপ্ত |চন্দ্রগুপ্তের মধ্যে লুকিয়ে লুকিয়ে সম্ভাবনা গুলিকে চাণক্য চিহ্নিত করেছিলেন | তখন আলেকজান্ডার নাম এক রাজপুরুষ ভারতের পশ্চিমী সীমান্তে এসে পড়েছেন |মগধের রাজকুমার অম্বিক তাঁর সঙ্গে গোপন সন্ধি করেছিলেন |আবার পর্বতেশ্বর বা পুরু আলেকজান্ডারের সেনার মোকাবিলাতে সাহস ও সামর্থের পরিচয় দিয়েছিলেন |শেষ অবধি আলেকজান্ডারের রণনীতির জয় হল |তিনি ধীরে ধীরে ভারতবর্ষের মধ্যে এগিয়ে চললেন
এই সময়ে চাণক্যের নেতৃত্বে চন্দ্রগুপ্ত একটি অত্যন্ত শক্তিশালী সেনাবাহিনী গড়ে তুললেন |এই সেনাবাহিনীর হাতে নানা ধরণের আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র তুলে দেওয়া হল |চাণক্য বুঝতে পেরেছিলেন শুধুমাত্র অস্ত্র হাতে থাকলেই সেনারা অসীম শক্তিশালী হয়ে ওঠে না, তাদের আসল শক্তি লুকিয়ে থাকে মানসিক ধৈর্য ও সাহসের উপর |যদি তারা স্বদেশ প্রেমের আগুনে উজ্জীবিত না হয় তাহলে রণক্ষেত্রে লড়াই করবে কেমন করে? তাই তিনি সেনাবাহিনীর মধ্যে কঠিন কঠোর
অনুশাসন এনেছিলেন |তিনি জ্বালাময়ী ভাষণের মাধ্যমে প্রত্যেক সৈনিক কে নতুন আদর্শে প্রাণিত করতেন |শেষ পর্যন্ত নন্দবংশের নাশ হল |চন্দ্রগুপ্ত মগধের শাসন ভার নিজের হাতে তুলে নিলেন |আলেকজান্ডারের সেনাপতি সেলুকাশের মেয়ে হেলেনের সঙ্গে চন্দ্রগুপ্তের বিয়ে হল |ধননন্দের প্রধান অমাত্য রাক্ষস চন্দ্রগুপ্তের প্রধান অমাত্য হলেন |ভারত আরও একবার খণ্ডবিখণ্ড হওয়ার হাত থেকে রক্ষা পেলো |
এবার চাণক্য আর বিস্তীর্ণ প্রেক্ষাপটে নিজেকে প্রতিশিষ্ট করলেন |একাধারে তিনি হলেন চন্দ্রগুপ্তের প্রধান উপদেষ্টা এবং এক বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক |জীবনে চলার পথে আমাদের নানা ধরণের বাধা অতিক্রম করতে হয় |অনভিজ্ঞতা এসে আমাদের গ্রাসঃ করে |অন্ধকারে আমরা
আচ্ছন্ন হয়ে যাই |নৈরাশ্যবাদ আমাদের আক্রাতন্ত করে | আমরা কিভাবে আমাদের দৈনন্দিন জীবন যাত্রাকে আরও ইতিবাচক করে তুলতে পারবো তা নিয়ে চাণক্য বিস্তর গবেষণা করেছিলেন |তিনি এই প্রসঙ্গে বেশ কিছু নীতি এবং শাস্ত্র প্রণয়ন করেন |তাঁর লেখা এই নীতিগুলি আজও আমরা পালন করে চলেছি |যদিও গত দুহাজার বছরে পৃথিবীর পরিবেশ পাল্টে গেছে, কিন্তু চাণক্য নীতির প্রয়োগের কথা আজও আমাদের মনে হয় |অর্থাৎ আজও এই নীতিগুলির গগ্রহনযোগ্যতা এতটুকু কমেনি |
অনেকে চাণক্যের সঙ্গে বিখ্যাত পাশ্চাত্য অর্থনীতিবিদ ম্যাকিয়াভেলীর তুলনা করে থাকেন |ম্যাকিয়াভেলি যেমন সম্পূর্ণ নতুন দৃষ্টিকোণ থেকে অর্থশাস্ত্রের বিভিন্ন বিষয়ের ওপর আলোচনা করেছেন, চাণক্য ঠিক সেইভাবে প্রাচীন ভারতের অর্থনীতির ওপর একটি বিশ্লেষণ মূলক গ্রন্থ লিখেছেন |এই গ্রন্থটি আজও আমরা যথেষ্ট গুরুত্ব সহকারে পাঠ করে থাকি |সংক্ষেপে এই হল চাণক্যের জীবন এবং জীবন দর্শনের কথা
Tags:
জীবনী